এ কী হরষ হেরি কাননে।
পরান আকুল, স্বপন বিকশিত
মোহমদিরাময় নয়নে॥

ফলে ফুলে করিছে কোলাকুলি,
বনে বনে বহিছে সমীরণ
নবপল্লবে হিল্লোল তুলিয়ে--
বসন্তপরশে বন শিহরে।
কী জানি কোথা পরান মন
ধাইছে বসন্তসমীরণে॥

ফুলেতে শুয়ে জোছনা
হাসিতে হাসি মিলাইছে।
মেঘ ঘুমায়ে ঘুমায়ে ভেসে যায়।
ঘুমভারে অলসা বসুন্ধরা--
দূরে পাপিয়া পিউ-পিউ রবে
ডাকিছে সঘনে॥


Song: E Ki Harosh Heri Kanone
Singer: Navonil Hazra
Lyrics: Rabindronath Tagore







এ পথ গেছে কোন্‌খানে

এ পথ গেছে কোন্‌খানে গো কোন্‌খানে--
তা  কে জানে তা কে জানে ॥

কোন্‌ পাহাড়ের পারে,
কোন্‌ সাগরের ধারে,
কোন্‌ দুরাশায় দিক-পানে--
তা  কে জানে তা কে জানে ॥

এ পথ দিয়ে কে আসে যায় কোন্‌খানে
তা  কে জানে তা কে জানে।
কেমন যে তার বাণী, কেমন হাসিখানি,
যায় সে কাহার সন্ধানে--
তা  কে জানে তা কে জানে ॥






একলা ব'সে একে একে অন্যমনে

একলা ব'সে একে একে অন্যমনে
পদ্মের দল ভাসাও জলে অকারণে।
হায় রে, বুঝি কখন তুমি গেছ ভুলে
ও যে আমি এনেছিলেম আপনি তুলে,
রেখেছিলেম প্রভাতে ওই চরণমূলে   অকারণে--
কখন তুলে নিলে হাতে যাবার ক্ষণে   অন্যমনে॥

দিনের পরে দিনগুলি মোর এমনি ভাবে
তোমার হাতে ছিঁড়ে হারিয়ে যাবে।
সবগুলি এই শেষ হবে যেই তোমার খেলায়
এমনি তোমার আলস-ভরা অবহেলায়
হয়তো তখন বাজবে ব্যথা সন্ধেবেলায়   অকারণে--
চোখের জলের লাগবে আভাস নয়নকোণে   অন্যমনে॥








একটি নমস্কারে প্রভু একটি নমস্কারে

একটি নমস্কারে, প্রভু, একটি নমস্কারে
সকল দেহ লুটিয়ে পড়ুক তোমার এ সংসারে ॥

ঘন শ্রাবণমেঘের মতো  রসের ভারে নম্র নত
একটি নমস্কারে, প্রভু, একটি নমস্কারে
সমস্ত মন পড়িয়া থাক্‌ তব ভবনদ্বারে ॥

নানা সুরের আকুল ধারা  মিলিয়ে দিয়ে আত্মহারা
একটি নমস্কারে, প্রভু, একটি নমস্কারে
সমস্ত গান সমাপ্ত হোক নীরব পারাবারে।

হংস যেমন মানসযাত্রী  তেমনি সারা দিবসরাত্রি
একটি নমস্কারে, প্রভু, একটি নমস্কারে
সমস্ত প্রাণ উড়ে চলুক মহামরণ-পারে ॥









এ দিন আজি কোন ঘরে গো

এ দিন আজি কোন্‌ ঘরে গো খুলে দিল দ্বার?
আজি প্রাতে সূর্য ওঠা সফল হল কার?।

কাহার অভিষেকের তরে   সোনার ঘটে আলোক ভরে,
উষা কাহার আশিস বহি হল আঁধার পার?।

বনে বনে ফুল ফুটেছে, দোলে নবীন পাতা--
কার হৃদয়ের মাঝে হল তাদের মালা গাঁথা?

বহু যুগের উপহারে   বরণ করি নিল কারে,
কার জীবনে প্রভাত আজি ঘুচায় অন্ধকার?।






এই তো তোমার আলোকধেনু

এই তো তোমার আলোকধেনু
সূর্য তারা দলে দলে--
কোথায় ব'সে বাজাও বেণু,
চরাও মহাগগনতলে ॥

তৃণের সারি তুলছে মাথা,
তরুর শাখে শ্যামল পাতা--
আলোয়-চরা ধেনু এরা
ভিড় করেছে ফুল ফলে ॥

সকালবেলা দূরে দূরে
উড়িয়ে ধূলি কোথায় ছোটে,
আঁধার হলে সাঁজের সুরে
ফিরিয়ে আন আপন গোঠে।

আশা তৃষা আমার যত
ঘুরে বেড়ায় কোথায় কত--
মোর জীবনের রাখাল ওগো
ডাক দেবে কি সন্ধ্যা হলে?।







একি মায়া লুকাও কায়া

একি মায়া, লুকাও কায়া
জীর্ণ শীতের সাজে।
আমার সয় না, সয় না, সয় না প্রাণে,
কিছুতে সয় না যে॥

কৃপণ হয়ে হে মহারাজ,
রইবে কি আজ
আপন ভুবন-মাঝে॥

বুঝতে নারি বনের বীণা
তোমার প্রসাদ পাবে কিনা,
হিমের হাওয়ায় গগন-ভরা
ব্যাকুল রোদন বাজে॥

কেন মরুর পারে কাটাও বেলা
রসের কাণ্ডারী।
লুকিয়ে আছে কোথায় তোমার
রূপের ভাণ্ডারী।

রিক্তপাতা শুষ্ক শাখে
কোকিল তোমার কই গো ডাকে--
শূন্য সভা, মৌন বাণী,
আমরা মরি লাজে॥







এতদিন যে বসেছিলেম

এতদিন যে বসেছিলেম
পথ চেয়ে আর কাল গুনে
দেখা পেলেম ফাল্গুনে॥

বালক বীরের বেশে তুমি করলে বিশ্বজয়--
এ কী গো বিস্ময়।
অবাক আমি তরুণ গলার গান শুনে॥

গন্ধে উদাস হাওয়ার মতো
উড়ে তোমার উত্তরী,
কর্ণে তোমার কৃষ্ণচূড়ার মঞ্জরী।

তরুণ হাসির আড়ালে কোন্‌ আগুন ঢাকা রয়--
এ কী গো বিস্ময়।
অস্ত্র তোমার গোপন রাখ কোন্‌ তূণে॥








এবার তোর মরা গাঙে বান এসেছে

এবার তোর মরা গাঙে বান এসেছে,
'জয় মা' ব'লে ভাসা তরী ॥

ওরে রে ওরে মাঝি, কোথায় মাঝি,
প্রাণপণে, ভাই, ডাক দে আজি--
তোরা  সবাই মিলে বৈঠা নে রে,
খুলে ফেল্‌ সব দড়াদড়ি ॥

দিনে দিনে বাড়ল দেনা,
ও ভাই, করলি নে কেউ
বেচা কেনা--
হাতে নাই রে কড়া কড়ি।

ঘাটে বাঁধা দিন গেল রে,
মুখ দেখাবি কেমন ক'রে--
ওরে, দে খুলে দে, পাল তুলে দে,
যা হয় হবে বাঁচি মরি ॥







এবার উজাড় করে লও হে আমার

এবার উজাড় করে লও হে আমার
যা-কিছু সম্বল।
ফিরে দাও, ফিরে চাও,
ফিরে চাও ওগো চঞ্চল॥

চৈত্ররাতের বেলায় নাহয়
এক প্রহরের খেলায়
আমার স্বপনস্বরূপিনী প্রাণে
দাও পেতে অঞ্চল।

যদি এই ছিল গো মনে,
যদি পরম দিনের স্মরণ ঘুচাও
চরম অযতনে,
তবে ভাঙা খেলার ঘরে নাহয়
দাঁড়াও ক্ষণেক-তরে----
সেথা ধুলায় ধুলায় ছাড়াও হেলায়
ছিন্ন ফুলের দল।










এবার অবগুণ্ঠন খোলো

এবার অবগুণ্ঠন খোলো।
গহন মেঘমায়ায় বিজন বনছায়ায়
তোমার আলসে অবলুণ্ঠন সারা হল॥

শিউলিসুরভি রাতে
বিকশিত জ্যোৎস্নাতে
মৃদু মর্মরগানে তব
মর্মের বাণী বোলো ॥

বিষাদ-অশ্রুজলে
মিলুক শরমহাসি--
মালতীবিতানতলে
বাজুক বঁধুর বাঁশি।

শিশিরসিক্ত বায়ে
বিজড়িত আলোছায়ে
বিরহ-মিলনে-গাঁথা
নব প্রণয়দোলায় দোলো ॥







এবার আমায় ডাকলে দূরে

এবার আমায় ডাকলে দূরে
সাগর-পারের গোপন পুরে ॥

বোঝা আমার নামিয়েছি যে,
সঙ্গে আমায় নাও গো নিজে,
স্তব্ধ রাতের স্নিগ্ধ সুধা
পান করাবে তৃষ্ণাতুরে ॥

আমার সন্ধ্যাফুলের মধু
এবার যে ভোগ করবে বঁধু।
তারার আলোর প্রদীপখানি
প্রাণে আমার জ্বালবে আনি,
আমার যত কথা ছিল
ভেসে যাবে তোমার সুরে ॥









এরা পরকে আপন করে

এরা পরকে আপন করে, আপনারে পর--
বাহিরে বাঁশির রবে ছেড়ে যায় ঘর॥

ভালোবাসে সুখে দুখে ব্যথা সহে হাসিমুখে,
মরণেরে করে চিরজীবননির্ভর॥






এল যে শীতের বেলা বরষ পরে

এল যে শীতের বেলা বরষ-পরে।
এবার ফসল কাটো, লও গো ঘরে॥

করো ত্বরা, করো ত্বরা,
কাজ আছে মাঠ-ভরা--
দেখিতে দেখিতে দিন আঁধার করে॥

বাহিরে কাজের পালা হইবে সারা
আকাশে উঠিবে যবে সন্ধ্যাতারা--
আসন আপন হাতে
পেতে রেখো আঙিনাতে
যে সাথি আসিবে রাতে তাহারি তরে॥









এসো নীপবনে ছায়াবীথিতলে

এসো নীপবনে ছায়াবীথিতলে,
এসো করো স্নান নবধারাজলে॥

দাও আকুলিয়া ঘন কালো কেশ,
পরো দেহ ঘেরি মেঘনীল বেশ--
কাজলনয়নে, যূথীমালা গলে,
এসো নীপবনে ছায়াবীথিতলে॥

আজি ক্ষণে ক্ষণে হাসিখানি, সখী,
অধরে নয়নে উঠুক চমকি।
মল্লারগানে তব মধুস্বরে
দিক্‌ বাণী আনি বনমর্মরে।
ঘনবরিষনে জলকলকলে
এসো নীপবনে ছায়াবীথিতলে॥







এসো আমার ঘরে

এসো আমার ঘরে।
বাহির হয়ে এসো তুমি যে আছ অন্তরে॥

স্বপনদুয়ার খুলে এসো অরুণ-আলোকে
মুগ্ধ এ চোখে।
ক্ষণকালের আভাস হতে চিরকালের তরে
এসে আমার ঘরে॥

দুঃখসুখের দোলে এসো,
প্রাণের হিল্লোলে এসো।
ছিলে আশার অরূপ বাণী ফাগুনবাতাসে
বনের আকুল নিশ্বাসে--
এবার ফুলের প্রফুল্ল রূপ এসো বুকের 'পরে॥







এসেছিলে তবু আস নাই

এসেছিলে তবু আস নাই
জানায়ে গেলে
সমুখের পথ দিয়ে
পলাতকা ছায়া ফেলে॥

তোমার সে উদাসীনতা
সত্য কিনা জানি না সে,
চঞ্চল চরণ গেল ঘাসে ঘাসে
বেদনা মেলে॥

তখন পাতায় পাতায়
বিন্দু বিন্দু ঝরে জল,
শ্যামল বনান্তভূমি
করে ছলোছল্‌।

তুমি চলে গেছ ধীরে ধীরে
সিক্ত সমীরে,
পিছনে নীপবীথিকায়
রৌদ্রছায়া যায় খেলে॥







উতল-ধারা বাদল ঝরে

উতল-ধারা বাদল ঝরে
সকল বেলা একা ঘরে॥

সজল হাওয়া বহে বেগে,
পাগল নদী ওঠে জেগে,
আকাশ ঘেরে কাজল মেঘে,
তমালবনে আঁধার করে॥

ওগো বঁধু দিনের শেষে
এলে তুমি কেমন বেশে--
আঁচল দিয়ে শুকাব জল,
মুছাব পা আকুল কেশে।

নিবিড় হবে তিমির-রাতি,
জ্বেলে দেব প্রেমের বাতি,
পরানখানি দেব পাতি--
চরণ রেখো তাহার 'পরে॥

ভুলে গিয়ে জীবন মরণ
লব তোমায় ক'রে বরণ--
করিব জয় শরম-ত্রাসে,
দাঁড়াব আজ তোমার পাশে--

বাঁধন বাধা যাবে জ্ব'লে
সুখ দুঃখ দেব দ'লে,
ঝড়ের রাতে তোমার সাথে
বাহির হব অভয়ভরে॥

উতল-ধারা বাদল ঝরে,
দুয়ার খুলে এলে ঘরে।
চোখে আমার ঝলক লাগে,
সকল মনে পুলক জাগে,
চাহিতে চাই মুখের বাগে--
নয়ন মেলে কাঁপি ডরে॥