আমি কেবলই স্বপন করেছি বপন বাতাসে--
তাই আকাশকুসুম করিনু চয়ন হতাশে ॥
ছায়ার মতন মিলায় ধরণী,
কূল নাহি পায় আশায় তরণী,
মানসপ্রতিমা ভাসিয়া বেড়ায় আকাশে ॥
কিছু বাঁধা পড়িল না কেবলই বাসনা-বাঁধনে।
কেহ নাহি দিল ধরা শুধু এ সুদূর-সাধনে।
আপনার মনে বসিয়া একেলা
অনলশিখায় কী করিনু খেলা,
দিনশেষে দেখি ছাই হল সব হুতাশে॥
আমি কেমন করিয়া জানাব আমার
আমি কেমন করিয়া জানাব আমার
জুড়ালো হৃদয় জুড়ালো--
আমার জুড়ালো হৃদয় প্রভাতে।
আমি কেমন করিয়া জানাব আমার
পরান কী নিধি কুড়ালো--
ডুবিয়া নিবিড় গভীর শোভাতে ॥
আজ গিয়েছি সবার মাঝারে,
সেথায় দেখেছি আলোক-আসনে--
দেখেছি আমার হৃদয়রাজারে।
আমি দুয়েকটি কথা কয়েছি তা সনে
সে নীরব সভা-মাঝারে--
দেখেছি চিরজনমের রাজারে ॥
এই বাতাস আমারে হৃদয়ে লয়েছে,
আলোক আমার তনুতে
কেমনে মিলে গেছে মোর তনুতে--
তাই এ গগন-ভরা প্রভাত পশিল
আমার অণুতে অণুতে।
আজ ত্রিভুবন-জোড়া কাহার বক্ষে
দেহ মন মোর ফুরালো--
যেন রে নিঃশেষে আজি ফুরালো।
আজ যেখানে যা হেরি সকলেরই মাঝে
জুড়ালো জীবন জুড়ালো--
আমার আদি ও অন্ত জুড়ালো ॥
আমি চঞ্চল হে
আমি চঞ্চল হে,
আমি সুদূরের পিয়াসি।
দিন চলে যায়, আমি আনমনে
তারি আশা চেয়ে থাকি বাতায়নে--
ওগো, প্রাণে মনে আমি যে তাহার
পরশ পাবার প্রয়াসী॥
ওগো সুদূর, বিপুল সুদূর, তুমি যে
বাজাও ব্যাকুল বাঁশরি--
মোর ডানা নাই, আছি এক ঠাঁই
সে কথা যে যাই পাশরি॥
আমি উন্মনা হে,
হে সুদূর, আমি উদাসী॥
রৌদ্র-মাখানো অলস বেলায়
তরুমর্মরে ছায়ার খেলায়
কী মুরতি তব নীল আকাশে
নয়নে উঠে গো আভাসি।
হে সুদূর, আমি উদাসী।
ওগো সুদূর, বিপুল সুদূর, তুমি যে
বাজাও ব্যাকুল বাঁশরি--
কক্ষে আমার রুদ্ধ দুয়ার
সে কথা যে যাই পাশরি॥
আমি জ্বালব না মোর বাতায়নে
আমি জ্বালব না মোর বাতায়নে প্রদীপ আনি,
আমি শুনব বসে আঁধার-ভরা গভীর বাণী॥
আমার এ দেহ মন মিলায়ে যাক নিশীথরাতে,
আমার লুকিয়ে-ফোটা এই হৃদয়ের পুষ্পপাতে,
থাক্-না ঢাকা মোর বেদনার গন্ধখানি॥
আমার সকল হৃদয় উধাও হবে তারার মাঝে
যেখানে ওই আঁধারবীণায় আলো বাজে।
আমার সকল দিনের পথ খোঁজা এই হল সারা,
এখন দিক্-বিদিকের শেষে এসে দিশাহারা
কিসের আশায় বসে আছি অভয় মানি॥
আমি তোমায় যত শুনিয়েছিলাম গান
আমি তোমায় যত শুনিয়েছিলাম গান
তার বদলে আমি চাই নে কোনো দান ॥
ভুলবে সে গান যদি নাহয় যেয়ো ভুলে
উঠবে যখন তারা সন্ধ্যসাগরকূলে,
তোমার সভায় যবে করব অবসান
এই ক'দিনের শুধু এই ক'টি মোর তান ॥
তোমার গান যে কত শুনিয়েছিলে মোরে
সেই কথাটি তুমি ভুলবে কেমন করে?
সেই কথাটি, কবি, পড়বে তোমার মনে
বর্ষামুখর রাতে, ফাগুন-সমীরণে--
এইটুকু মোর শুধু রইল অভিমান
ভুলতে সে কি পার ভুলিয়েছ মোর প্রাণ ॥
আমি তোমার প্রেমে
আমি তোমার প্রেমে হব সবার কলঙ্কভাগী।
আমি সকল দাগে হব দাগি॥
তোমার পথের কাঁটা করব চয়ন,
যেথা তোমার ধুলার শয়ন
সেথা আঁচল পাতব আমার--
তোমার রাগে অনুরাগী॥
আমি শুচি-আসন টেনে টেনে
বেড়াব না বিধান মেনে,
যে পঙ্কে ওই চরণ পড়ে
তাহারি ছাপ বক্ষে মাগি॥
আমি তারেই জানি তারেই জানি
আমি তারেই জানি তারেই জানি
আমায় যে জন আপন জানে--
তারি দানে দাবি আমার
যার অধিকার আমার দানে ॥
যে আমারে চিনতে পারে
সেই চেনাতেই চিনি তারে গো--
একই আলো চেনার পথে
তার প্রাণে আর আমার প্রাণে ॥
আপন মনের অন্ধকারে ঢাকল যারা
আমি তাদের মধ্যে আপনহারা।
ছুঁইয়ে দিল সোনার কাঠি,
ঘুমের ঢাকা গেল কাটি গো--
নয়ন আমার ছুটেছে তার
আলো-করা মুখের পানে ॥
আমি মারের সাগর পাড়ি দেব
আমি মারের সাগর পাড়ি দেব
বিষম ঝড়ের বায়ে
আমার ভয়ভাঙা এই নায়ে ॥
মাভৈঃ বাণীর ভরসা নিয়ে
ছেঁড়া পালে বুক ফুলিয়ে
তোমার ওই পারেতেই যাবে তরী
ছায়াবটের ছায়ে ॥
পথ আমারে সেই দেখাবে
যে আমারে চায়--
আমি অভয় মনে ছাড়ব তরী,
এই শুধু মোর দায়।
দিন ফুরালে, জানি জানি,
পৌঁছে ঘাটে দেব আনি
আমার দুঃখদিনের রক্তকমল
তোমার করুণ পায়ে ॥
আমি যখন ছিলেম অন্ধ
আমি যখন ছিলেম অন্ধ
সুখের খেলায় বেলা গেছে,
পাই নি তো আনন্দ ॥
খেলাঘরের দেয়াল গেঁথে
খেয়াল নিয়ে ছিলেম মেতে,
ভিত ভেঙে যেই এলে ঘরে
ঘুচল আমার বন্ধ।
সুখের খেলা আর রোচে না,
পেয়েছি আনন্দ ॥
ভীষণ আমার, রুদ্র আমার,
নিদ্রা গেল ক্ষুদ্র আমার--
উগ্র ব্যথায় নূতন ক'রে
বাঁধলে আমার ছন্দ।
যে দিন তুমি অগ্নিবেশে
সব-কিছু মোর নিলে এসে
সে দিন আমি পূর্ণ হলেম
ঘুচল আমার দ্বন্দ্ব।
দুঃখসুখের পারে তোমায়
পেয়েছি আনন্দ ॥
আমি যে গান গাই
আমি যে গান গাই
জানি নে সে কার উদ্দেশে॥
যবে জাগে মনে অকারণে চঞ্চল হাওয়ায়,
প্রবাসী পাখি উড়ে যায়--
সুর যায় ভেসে কার উদ্দেশে॥
ওই মুখপানে চেয়ে দেখি--
তুমি সে কি অতীত কালের স্বপ্ন এলে
নূতন কালের বেশে।
কভু জাগে মনে আজও যে জাগে নি এ জীবনে
গানের খেয়া সে মাগে
আমার তীরে এসে॥
আর কত দূরে আছে সে আনন্দধাম
আর কত দূরে আছে সে আনন্দধাম।
আমি শ্রান্ত, আমি অন্ধ, আমি পথ নাহি জানি ॥
রবি যায় অস্তাচলে আঁধারে ঢাকে ধরণী--
করো কৃপা অনাথে হে বিশ্বজনজননী ॥
অতৃপ্ত বাসনা লাগি ফিরিয়াছি পথে পথে--
বৃথা খেলা, বৃথা মেলা, বৃথা বেলা গেল বহে।
আজি সন্ধ্যাসমীরণে লহো শান্তিনিকেতনে,
স্নেহকরপরশনে চিরশান্তি দেহো আনি ॥
আর নহে আর নহে
আর নহে, আর নহে--
বসন্তবাতাস কেন আর শুষ্ক ফুলে বহে॥
লগ্ন গেল বয়ে
সকল আশা লয়ে,
এ কোন্ প্রদীপ জ্বালো
এ যে বক্ষ আমার দহে॥
কানন মরু হল,
আজ এই সন্ধ্যা-অন্ধকারে
সেথায় কী ফুল তোলো।
কাহার ভাগ্য হতে
বরণমালা হরণ করো,
ভাঙা ডালি ভরো--
মিলনমালার কণ্টকভার
কণ্ঠে কি আর সহে॥
আরো আরো প্রভু আরো আরো
আরো আরো প্রভু, আরো আরো।
এমনি করে আমায় মারো।
লুকিয়ে থাকি আমি পালিয়ে বেড়াই,
ধরা পড়ে গেছি আর কি এড়াই?
যা কিছু আছে সব কাড়ো কাড়ো।
এবার যা করবার তা সারো সারো।
আমি হারি কিম্বা তুমিই হারো!
হাটে ঘাটে বাটে করি মেলা,
কেবল হেসে খেলে গেছে বেলা,
দেখি কেমনে কাঁদাতে পারো।
আলোর অমল কমলখানি
আলোর অমল কমলখানি কে ফুটালে,
নীল আকাশের ঘুম ছুটালে॥
আমার মনের ভাব্নাগুলি
বাহির হল পাখা তুলি,
ওই কমলের পথে তাদের সেই জুটালে॥
শরতবাণীর বীণা বাজে কমলদলে।
ললিত রাগের সুর ঝরে তাই শিউলিতলে।
তাই তো বাতাস বেড়ায় মেতে
কচি ধানের সবুজ ক্ষেতে,
বনের প্রাণে মর্মরানির ঢেউ উঠালে॥
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন
=== জয় গুরু ===
বিশুদ্ধ প্রচারের স্বার্থে, লিরিক্সে ভুলভ্রান্তি
অথবা, আপনার যে কোন মন্তব্য, অভিযোগ, অনুরোধ, আমাদের কমেন্ট করে জানান। ...